সর্পিল উঁচুনিচু শ্বাসরুদ্ধকর পাহাড়ী রাস্তা, চারপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়, মেঘের সাথে ছোয়াছুঁয়ি, পাহাড়ের ওপর হ্রদ, ঝর্ণার ধারা, পাহাড়ী নদীর খররাত, বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া; ভ্রমনের জন্য এরচেয়ে ভালো স্থান আর কিইবা হতে পারে! হ্যাঁ বাংলাদেশকে প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার, বান্দরবানের কথাই বলছি। সময় সুযোগ মিলিয়ে রওনা দিতে পারেন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।
বান্দরবান সম্পর্কে কিছু কথা:
দেশের সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ জেলা বান্দরবান। ৭টি উপজেলায় বিভক্ত এ জেলার প্রসাশনিক এলাকা; এরা হলো- বান্দরবান সদর, আলীকদম, থানচি, নাইক্ষংছড়ি, লামা, রুমা, রোয়াংছড়ি। জেলাটিকে ঘিরে রয়েছে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে মায়ানমারের আরাকান ও চিন প্রদেশের সীমান্ত। এই জেলাটি মারমা রাজা অংশুপ্রু এর বাসভূমি হিসেবেও পরিচিত। প্রধান নদী সাঙ্গু; এছাড়াও রয়েছে মাতামুহুরী ও বাকখালী। প্রধান গিরিশ্রেণী ৪টি- মেরেঞ্জা, ওয়াইলাটং, তামবাং ও পলিতাল।
যা যা আছে দেখার মত:
সাঙ্গু নদী: এই নদীটি স্থানীয় ভাবে সাংপো বা শঙ্খ নদী নামেও পরিচিত।
সাঙ্গু দেশের একমাত্র নদী যেটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হয়। মজার বিষয় এই নদীটির উৎপত্তিস্থল বান্দরবান জেলার মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ের ওপর মদক নামক স্থানে। বান্দরবান শহরের পাশ ঘেঁষেই নদীটি বইছে। পহাড়ের ওপর থেকে বা নদীপথে রুমা যাওয়ার সময় এর মোহনীয় রূপ উপভোগ করা সম্ভব।
স্বর্ণমন্দির: শহর থেকে মাত্র ৪ কি:মি: উত্তরে বালাঘাটে অবস্থিত বৌদ্ধ ধাতু জাদি যা স্বর্ণমন্দির নামেই বেশী পরিচিত। মায়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড এর বৌদ্ধমন্দির গুলোর আদলে তৈরি এই মন্দিরে প্রবেশ করলে একটি শান্তিময় পরিবেশ আপনাকে স্বাগত জানাবে। দেশের সর্ববৃহৎ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই মন্দিরটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয়।
বোমাং রাজবাড়ী: মোটামুটি বান্দরবান শহরের কেন্দ্রেস্থলে ১৯৩৪ সালে রাজা ক্যজা সাইন এর আমলে নির্মিত বোমাং রাজবাড়ী দেখে আসতে ভুলবেন না। তবে আগের সেই জৌলুশ এখন আর নেই।
মেঘলা: বান্দরবান জেলার অন্যতম পরিচিত পর্যটন স্থান হলো মেঘলা। শহরে ঢোকার ৭ কি:মি: আগে অবস্থিত মেঘলায় প্রবেশ করতে হলে ১০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। এখানে এসে পাহাড়ি রাস্তায় হাটার পাশাপাশি হ্রদের ওপর নির্মিত ঝুলন্ত সেতু অথবা প্যাডেল বোটে চড়ে হ্রদের টলটলে পানি উপভোগ করা যাবে। পুরো বান্দরবানে বানরের দেখা না পেলেও মেঘলার মিনি চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্ধী বানর দেখতে পাবেন, আরও আছে ভল্লুক ও চিত্রাহরিন।
নীলাচল ও শুভ্রনীলা: শহর থেকে ৫ কি:মি: দূরে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ওপর অবস্থিত দুটি পর্যটন স্থান হচ্ছে নীলাচল ও শুভ্রনীলা। চারপাশে সারিসারি পাহাড়, আকাশের হাতছানি, সূর্যালোক মেঘের লুকোচুরি- এ যেন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। নীলাচল এর কোল ঘেঁষেই রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। পুরো বান্দরবান শহর পাহাড়ের ওপর দেখতে চাইলে শুভ্রনীলা হতে পারে আপনার জন্য সঠিক গন্তব্য। আকাশ পরিষ্কার থাকা সাপেক্ষে রাতের চট্টগ্রাম বন্দরের অলোকচ্ছটা দেখার সুযোগও মিলতে পারে।
শৈলপ্রপাত: বান্দরবান এর রুমা সড়কের পাশে শহর থেকে ৮ কি:মি: দূরে অবস্থিত প্রাকিতিক ঝর্ণা হচ্ছে শৈলপ্রপাত। বর্ষাকালে প্রচুর পানি থাকলেও শীতের সময় ক্ষীণধারায় পানি নামতে থাকে তবুও ঝর্ণার শীতল পানির ধারা আপনার শরীর-মন জুড়িয়ে দিবে। এখানে বম আদিবাসী গোষ্ঠীর উৎপাদিত ফলমূল; হাতে বোনা চাদর, মাফলার, বেডশীট ইত্যাদি এবং বাঁশবেতের তৈরি তৈজসপত্র পাওয়া যায়।
প্রান্তিক লেক: বান্দরবান যদি আপনার গন্তব্য হয় পিকনিক করার জন্য সেক্ষেত্রে প্রান্তিক লেক হওয়া উচিৎ প্রথম পছন্দ। প্রায় ৩০ একর যায়গা জুড়ে তৈরি এই কৃত্রিম হ্রদটি বিভিন্ন প্রজাতির গাছাপালায় ঘেরা। শহর থেকে ১৪ কি:মি: দূরত্বের এই হ্রদে পিকনিক এ আসা ভ্রমনার্থীদের আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করার জন্য রয়েছে উন্মুক্ত মাটির মঞ্চ, বিশ্রামাগার ও লেকের সৌন্দর্য্য অবলোকনের জন্য উঁচু ঘর।
চিম্বুক: ২৩০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত চিম্বুক। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে এই পাহাড়ের চূড়ায় সরাসরি গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। শহর থেকে দূরত্ব ২৬ কি:মি:। চিম্বুক যাওয়ার সময় রাস্তার দুপাশের দৃশ্য আপনার চিত্তকে মুগ্ধ করবে। আর উঁচুনিচু পাহাড়ী রাস্তা অন্য রকম এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। বর্ষার সময় গেলে চিম্বুকে গা ঘেষে চলে যাওয়া মেঘ দেখে সেটিকে মেঘপুরী বলেই মনে হবে আর মেঘ ছুঁয়ে দেখার সুযোগ তো থাকছেই। চিম্বুকের পাদদেশে মুরং এবং রা আদিবাসীদের বাস।
নীলগিরি: যদি সত্যিকার অর্থে মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে মেঘৈর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চান তাহলে আপনাকে যেতে হবে নীলগিরি। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের দূরত্ব ৪৮ কি:মি: এবং এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখানে রয়েছে কনফারেন্স হল, রেস্টুরেন্ট ও কটেজ। নীলগিরি ভ্রমনের পথে রাস্তার পাশ থেকে নেমে যাওয়া বিস্তির্ণ গিরিখাত ও মেঘের ছোটাছুটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আগে থেকে অনুমতি নিয়ে গেলে নীলগিরিতে রাত্রিযাপনের সুযোগও রয়েছে।